জাতিসংঘের মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের আটটি লক্ষ্যকে সামনে রেখেই মাইক্রোসফট আয়োজন করে থাকে ইমাজিন কাপ। ২০০৩ সাল থেকে শুরু হওয়া এই প্রতিযোগিতায় গত বছর প্রথম অংশ নেওয়ার পর এবারেও বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করছে। সম্প্রতি ইমাজিন কাপের বাংলাদেশ পর্বের চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে, নির্ধারিত হয়েছে বিজয়ী দল, যারা অংশ নিবে জুনে অস্ট্রেলিয়ায় ইমাজিন কাপের চূড়ান্ত পর্বে।
গত বছরেই প্রথম বাংলাদেশ থেকে প্রথম একটি দল অংশ নেয় ইমাজিন কাপে। বাংলাদেশ থেকে অংশ নেওয়া ‘টিম র্যাপচার’ তাদের ‘থার্ড আই’ দিয়ে মূল প্রতিযোগিতায় ‘পিপলস চয়েজ’ ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হয়ে ফিরে আসে। গতবারের ধারাবাহিকতায় এবারেও বাংলাদেশ থেকে একটি দল অংশ নেবে ইমাজিন কাপের মূল পর্বে। আর তার জন্য অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ইমাজিন কাপের বাংলাদেশ পর্বের চূড়ান্ত পর্ব। গতবছর ডিসেম্বর মাস থেকে দেশব্যাপী ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমাজিন কাপের ক্যাম্পেইন চালানো হয় এবং আগ্রহী দলের আবেদন এবছরের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩০০টি দল এতে অংশগ্রহণের আবেদন জানায় এতে। সেখান থেকে ১৪টি দলের আবেদন প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করে তাদের দ্বিতীয় পর্বে উন্নীত করা হয়। এর মধ্যে ১৫ এপ্রিল ৯টি দল তাদের প্রকল্প সফলভাবে তৈরী করতে সক্ষম হয় এবং তাদের নিয়েই বাংলাদেশ পর্বের চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
এই নয়টি দলের নয়টি প্রকল্পের মধ্যে তিনটি দলের প্রকল্পের ধারণা ছিলো সুন্দর, কিন্তু তাদের প্রকল্প সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়নি। এই তিনটি প্রকল্পকে বিশেষ উদ্ভাবনী পুরস্কার প্রদান করা হয়। এদের মধ্যে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির দল ইউআইইউ-স্ট্রাগলার তাদের ‘বাংলা ওসিআর’-এর জন্য লাভ করে জিপি আইটি বিশেষ উদ্ভাবনী পুরস্কার। দ্বিতীয় জিপি আইটি বিশেষ উদ্ভাবনী পুরস্কার লাভ করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমওআর দলকে তাদের ‘আই কন্ট্রোলড কার্সার’-এর জন্য। তৃতীয় উদ্ভাবনী পুরস্কারটি দেয়া হয় দৃক আইসিটির পক্ষ থেকে এবং পুরস্কারটি জিতে নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইটি বিভাগের দল আইআইটি ফনিক্স-এর প্রকল্প বেটার টুগেদার।
এরপরে চূড়ান্ত পুরস্কারে আহসানুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের এইউএসটি ফোরবিট পায় তৃতীয় পুরস্কার তাদের ‘হেল্পিং সিস্টেম ফর ফিজিক্যালি ডিজেবল পিপল ইউজিং ভয়েস প্রসেসিং’ প্রকল্পের জন্য। দ্বিতীয় পুরস্কার বিজয়ী দল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের লেপ্রেকন, তাদের প্রকল্প ‘প্রজেক্ট বিটল’। আর বুয়েট, এআইউইবি ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে গঠিত দল ‘ইঞ্জিন’-এর প্রকল্প ‘অন্নপূর্ণা’ জিতে নেয় চাম্পিয়ানের স্থান।
‘ইউআইইউ বাংলা ওসিআর’ নিয়ে ইউআইইউ স্ট্রাগলার্স
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির দল ইউআইইউ ইমাজিন কাপে অংশ নিয়েছে তাদের ‘ইউআইইউ বাংলা ওসিআর’ নিয়ে। এটি একটি বাংলা বর্ণ সনাক্তকারী সফটওয়্যার যা যেকোনো স্ক্যান করা বাংলা ডক্যুমেন্টকে মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে সম্পাদনাযোগ্য ডক্যুমেন্টে রূপান্তরিত করতে পারে। এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষার জন্য ভালো কোনো ওসিআর সফটওয়্যার নেই। উইন্ডোজ প্ল্যাটফর্মের জন্য তৈরি এই সফটওয়্যারটি সেই অভাব পূরণ করতে পারবে বলেই আশাবাদী নির্মাতারা। এটি ব্যবহার করে পুরোনো সাহিত্যকর্ম বা পত্রিকার ডিজিটাল সংস্করণ তৈরি করা বা বাংলায় লিখিত ডক্যুমেন্টকে ইংরেজিতে রূপান্তর করা অনেক সহজ হবে। ই-গভর্ন্যান্সের ক্ষেত্রেও এটি ভূমিকা রাখতে পারবে।
‘আই কন্ট্রোলড কার্সার’ নিয়ে এমওআর
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবনী দল এমওআর তৈরি করেছে ‘আই কন্ট্রোলড কার্সার’। স্বাভাবিকভাবে কম্পিউটার পরিচালনার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ মাউস হলেও একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী মাউস ব্যবহারে সক্ষম হয় না। তাদের সহায়তা করার জন্যই তৈর করা হয়েছে এই ‘আই কন্ট্রোলড কার্সার’। উইন্ডোজের জন্য তৈরি করা এই অ্যাপ্লিকেশনটি দিয়ে চোখের মাধ্যমেই পুরো কম্পিউটারকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন কেবল একটি ওয়েবক্যাম। সিস্টেমটি ওয়েবক্যাম থেকে সরাসরি ছবি নিয়ে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে চোখের অংশটুকু নির্ণয় করে। সেখান থেকে চোখের অবস্থানের গতিবিধি পরিমাপ করে মাউস পয়েন্টারকে চালনা করা হয়।
‘বেটার টুগেদার’ নিয়ে আইআইটি ফনিক্স
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ আইটি’র দল আইআইটি ফনিক্স তৈরি করেছে দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী ইন্টারনেটভিত্তিক সিস্টেম ‘বেটার টুগেদার’। এর মাধ্যমে বিশ্বের যেকোন প্রান্ত থেকে গ্রহীতারা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী আর্থিক সাহায্যের জন্য আবেদন করতে পারবেন। সিস্টেম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর গ্রহীতার প্রদত্ত তথ্যের সত্যতা যাচাই করে আবেদন অনুমোদন করবেন এবং আগ্রহী দাতাগণ অনুমোদিত আবেদনের তালিকা দেখে তাদের পছন্দ অনুসারে অর্থ দান করতে পারেন। দান করা অর্থ ই-ক্যাশের মাধ্যমে মুহূর্তেই সাহায্য আবেদনকারীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পৌঁছে যাবে। বেটার টুগেদার এভাবে বিশ্বব্যাপী দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে একটি নেটওয়ার্ক স্থাপন এবং প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়তা করবে।
স্মার্ট অ্যাগ্রো (Smartagro)’ নিয়ে অ্যাংগ্রি কোডার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবক দল অ্যাংগ্রি কোডার তৈরি করেছে অলাভজনক সামাজিক ব্যাবসা প্রকল্প স্মার্ট অ্যাগ্রো। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য, মাতৃ মৃত্যু, শিশু মৃত্যু, ফল-ফসলের ব্যাপক রোগবালাই ও পরিবেশ বিপর্যয়ের মত পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মোকাবেলায় নির্মিত হয়েছে এই প্রকল্প। কৃষিক্ষেত্রে এই প্রকল্পে থাকবে একজন সুপারভাইজার, যার কাছে থাকবে একটি বিশেষ সফটওয়্যার সমৃদ্ধ উইন্ডোজ মোবাইল ফোন। এই সফটওয়্যার বন্যায় প্লাবিত জমিতে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ, রোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের প্রতিকার, বন্যার সময় ঝুঁকিপূর্ণ রোগ-বালাইয়ের বর্ণনা ও তা প্রতিরোধের উপায়, গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতার নানান ধাপ প্রভৃতি বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য ধারণ করে। নিয়োগকৃত সুপারভাইজারের মাধ্যমে এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শটি প্রদান করে স্মার্ট অ্যাগ্রো নানান ধরনের সামাজিক সমস্যা নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারবে।
‘পকেট সুইচ’ নিয়ে জিরো আওয়ার
পটুয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দল জিরো আওয়ার তৈরি করেছে ‘পকেট সুইচ’। বিদ্যুতের অপচয় রোধ করার জন্য এই পকেট সুইচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। উইন্ডোজ মোবাইলের জন্য তৈরি এই অ্যাপ্লিকেশনটি ব্যবহার করে মোবাইলের মাধ্যমেই যেকোনো স্থান থেকে ঘরের যেকোনো ধরনের বৈদ্যুতিক সুইট বন্ধ করা যাবে। দূর নিয়ন্ত্রিত অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্রেও ব্যবহার করা যাবে এটি। ওয়েব সার্ভিস ও এফএম সিস্টেম ব্যবহার করে নানান ধরনের ডিভাইস এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
‘হাতে খড়ি’ নিয়ে ইউআইইউ ডায়নামিক্স
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির দল ইউআইইউ ডায়নামিক্স তৈরি করেছে শিক্ষামূলক সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন ‘হাতে খড়ি’। একটি ডিজিটাল প্যাডের মাধ্যমে পিসিতে বা উইন্ডোজ মোবাইলেও ব্যবহারযোগ্য এই অ্যাপ্লিকেশনটি একটি শিশুর ভাষা শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলা ছাড়াও আরও কয়েকটি ভাষায় এটি কাজ করতে সক্ষম। এতে লেখা দেখার পাশাপাশি লেখা শোনার ব্যবস্থা থাকয় স্বাভাবিক শিশুদের পাশাপাশি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরাও এর মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারবে। এছাড়া যাদের টাইপিংয়ের গতি অনেক কম, তারাও সহজেই এর মাধ্যমে নিজেদের প্রয়োজনীয় লেখা নিয়ে ডক্যুমেন্ট তৈরি করতে পারবে।
‘হেল্পিং সিস্টেম ফর ফিজিক্যালি ডিজেবল পিপল ইউজিং ভয়েস প্রসেসিং’ নিয়ে এইউএসটি ফোরবিট
আহসানুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের দল এইউএসটি ফোরবিট তৈরি করেছে শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষদের জন্য হেল্পিং সিস্টেম ফর ফিজিক্যালি ডিজ্যাবল পিপল ইউজিং ভয়েস প্রসেসিং। যাদের হাত-পা নেই বা থাকলেও ব্যবহারোপযোগী নয়, তাদের কণ্ঠস্বর ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নিয়মিত প্রয়োজনীয় কাজগুলো সঠিকভাবে সম্পাদন করতে সহায়তা করতেই এই এই সিস্টেমটি তৈরি করা হয়েছে। হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যারের সমন্বয়ে তৈরি এই সিস্টেমটি ব্যবহার করে কণ্ঠস্বরের সাহায্যে শারিরীক প্রতিবন্ধীরা ফ্যান, লাইটসহ সব ধরনের ইলেকট্রিক পণ্য চালু ও বন্ধ করতে পারবে। এছাড়া ফোন করা বা ফোন ধরার মত কাজও করতে পারবে। যাদের পা নেই, তাদের জন্য রয়েছে কণ্ঠস্বর নিয়ন্ত্রিত বিশেষ চাকাওয়ালা চেয়ার।
‘বিটল’ নিয়ে লেপ্রেকন
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবক দল খাদ্য সমস্যা মোকাবেলায় তৈরি করেছে ‘বিটল’ নামের সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশনটি। বিশ্বব্যাপী খাদ্য সমস্যার অন্যতম কারণ চাষাবাদের সময় পোকা এবং রোগের আক্রমণে ফসল নষ্ট হওয়া। বিটল-এর মাধ্যমে কৃষক তার ফসলের ক্ষতিগ্রস্ত পাতার ছবি তুলবে। এরপর বিটল তার ডাটাবেজ থেকে অন্যান্য ছবির সাথে মিলিয়ে পাতাটি কী ধরনের রোগে আক্রান্ত, তা জানিয়ে দেবে এবং তা রোধ করার জন্য কী উপায় অবলম্বন করতে হবে, তাও জানিয়ে দেবে। বিটল বর্তমান ফসলের রোগের ৫০% সমস্যা সমাধান করতে পারলেও এটি দিয়ে প্রতিবছর ৩৩ বিলিয়ন ডলার বাঁচানো সম্ভব।
তথ্যসূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক।