আগরবাতি হল কাঠিতে মশলামাখা সুগন্ধিযুক্ত এক ধরণের বাতি। আগরবাতিতে আগুন জ্বালালে তা ধীরে ধীরে পুড়ে চারপাশে সুগন্ধ ছড়ায়। সাধারণত বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব ও অনুষ্ঠানে আগরবাতি জ্বালানো হয়। আগরবাতি জ্বালালে ঘরের পরিবেশ ও চারপাশ সুগন্ধে ভরে যায়। ক্ষুদ্র ব্যবসা হিসেবে আগরবাতি তৈরি করে আয় করা সম্ভব। যে কোন ব্যক্তি নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার জন্য আগরবাতি তৈরির ব্যবসা শুরু করতে পারেন। আগরবাতির চাহিদা প্রায় সারাবছরই থাকে। মন্দির, মসজিদ, গির্জা প্রভৃতি উপাসনালয়ে বা বাড়িতে পূজা বা মিলাদে আগরবাতি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া সুগন্ধি হিসেবে এখন অনেকে প্রতিদিন ঘরে বা দোকানেও আগরবাতি ব্যবহার করেন। স্থানীয় বাজার, থানা শহর অথবা উপজেলা শহরে আগরবাতি বিক্রি করা যায়। পাইকারি হিসেবে দোকানদারদের কাছে অথবা খোলা বাজারে বা হাটে খুচরাভাবে ক্রেতাদের কাছে আগরবাতি বিক্রি করা সম্ভব। সবচেয়ে বেশি বিক্রি করা যায় মাজারের কাছে। এছাড়া বিভিন্ন উপাসনালয়ে আগরবাতি বিক্রি করা সম্ভব।
আগরবাতি তৈরির জন্য স্থায়ী উপকরণ কিনতে আনুমানিক ১৫০০ টাকার প্রয়োজন হবে। ১০০টি আগরবাতি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল কিনতে আনুমানিক ৩০০০ টাকার প্রয়োজন হবে। অভিজ্ঞ কারও কাছ থেকে আগরবাতি তৈরি এবং এ ব্যবসার বিস্তারিত জেনে নিলে ব্যবসা করতে সুবিধা হবে।
আগরবাতি তৈরি করতে যা যা লাগবে –
স্থায়ী উপকরণ
গামলা, বাটি, ডালা, চুলা, পিঁড়ি ও বেলন, দাঁড়িপাল্লা, চালনি, প্যাকেট
কাঁচামাল
রঙ, কাঠের গুড়া/ভূষি, কয়লার গুঁড়া, বিজলা গাছের ছাল, ডিপিই তেল, তরল সেন্ট, বাঁশের কাঠি
আগরবাতি তৈরির নিয়ম – কানুন
১। চিকন করে মাপ মতো বাঁশ কেটে টুকরো করতে হবে। নরম কাঠি ব্যবহার না করাই ভালো। কাঠিগুলো রঙিন করতে চাইলে গামলায় রঙ গুলে কাঠিগুলো সেই রঙে ভিজিয়ে রঙিন করতে হবে। এগুলোকে আগরবাতির কাঠি বা শলাকা বলে।
খুলনা নগরীর শেখপাড়ার স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় প্রায় প্রতিটি বাড়িতে তৈরি হয় আগরবাতির শলাকা। প্রতিদিন একজন কারিগর ৩-৪ কেজি শলাকা প্রস্তুত করতে পারে। প্রতি কেজি শলাকা মহাজনরা তাঁদের কাছ থেকে কিনে নেন ৩৮ থেকে ৪০ টাকায়। সেটা আবার ফ্যাক্টরির লোকদের কাছে ৪২-৪৫ টাকায় বিক্রি করা হয়। বর্ষা মৌসুমে এই দাম ৫-৮ টাকা করে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে খুলনা থেকে আগরবাতির শলাকা ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, বরিশাল, বগুড়া, যশোর, রাজশাহী, কুমিল্লা, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, খুলনার কপিলমুনির চালনা ও পাইকগাছার ফ্যাক্টরি মালিকরা কিনে নেন। আগরবাতির কাঠি আরো তৈরী করা হয় শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার ঘাগড়া গ্রামে।
২। বিজলা গাছের ছাল শুকিয়ে নিতে হবে। শুকনো বাকলগুলো ভেঙ্গে মেশিনে গুঁড়া করতে হবে অথবা শিল পাটাতে গুঁড়া করে নেওয়া যাবে। এখানে প্রসঙ্গত উল্যেখ্য যে, শুধুমাত্র রঙিন আগরবাতির জন্য কাঠের গুঁড়ার প্রয়োজন হয়। কালো আগরবাতি কয়লার গুঁড়া দিয়েই তৈরি করা যায়। কয়লা সংগ্রহ করে বেলুন দিয়ে পিষে গুঁড়া করে নেওয়া যায়। অথবা কয়লা গুঁড়া করার মেশিন যেখানে আছে সেখান থেকে সরাসরি গুঁড়া কয়লা কেনা যাবে। এরপর বিজলা গাছের ছাল ও কাঠের গুঁড়া বা কয়লার গুঁড়া আলাদা চালুনি দিয়ে চেলে নিতে হবে। যদি বড় গুঁড়া থাকে তাহলে তা আলাদা হয়ে যাবে। এখন সব গুঁড়া আলাদা আলাদা করে দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মেপে আলাদা বাটি বা প্যাকেটে রাখলে ভালো হবে। তাহলে কতটুকু পরিমাণ গুঁড়া আছে তা জানা যাবে এবং কাজ করতে সুবিধা হবে। যদি রঙিন আগরবাতি তৈরি করতে হয়, তাহলে গুঁড়ার সাথে রঙ মিশিয়ে নিতে হবে। আমাদের দেশে সাধারণত কালো সবুজ ও লাল রঙের আগরবাতি তৈরি করা হয়। তবে ইচ্ছে করলে নানান রঙের আগরবাতি তৈরি করা যাবে।
রাজধানী ঢাকার জুরাইনে অসংখ্য মানুষ এই ব্যাবসার সাথে পরোক্ষভাবে যুক্ত। প্রথমে হোটেলে হোটেলে আগে থেকেই কনট্র্যাক্ট করে রাখা হয়। সেই অনুযায়ী ছাই সংগ্রহ করে নিয়ে এসে আগে ভালো করে রোদে শুকাতে হয়। এতে সময় লাগে চার-পাঁচদিন (আবহাওয়ার উপর নির্ভরশীল)। এরপর এই ছাই সূক্ষ্ম জালির চালনি দিয়ে মিহি করা হয়। এই ছাই বা কয়লার পাউডার এর পাশাপাশি কাঠের গুঁড়ো, আগর গাছ/বিজলা গাছ/কাজলি গাছ-এর বাকলের পাউডারও রোদে দিয়ে শুকাতে হয়। এরপর একসঙ্গে মিশিয়ে মেশিনে ভাঙিয়ে বস্তায় ভরে মহাজনদের কাছে বিক্রি করা হয়। গাছের ছালবাকল ভাঙানোর মেশিনঘর খুঁজে পাওয়া যাবে দয়াগঞ্জ আর শনির আখড়ায়।
জুরাইন, দয়াগঞ্জ, শনির আখড়া থেকে শুরু করে সাদ্দাম মার্কেট হয়ে সানারপাড় পর্যন্ত বিশাল এলাকাজুড়ে শত শত মানুষ এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। কাঠের গুঁড়ো, কয়লার গুঁড়ো, বিজলা গাছের ছালের গুঁড়ো (আগর গাছ, কাজলি গাছ), বাঁশের কাঠি, রঙ, তরল সুগন্ধি ও পানি প্রয়োজন হয় আগরবাতি তৈরিতে। কয়লা দিয়া কাজ করলে ঝামেলায় পড়তে হয় কারন হোটেলে পোড়ানো কাঠ অনেক সময় পূর্বেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাই কয়লার মধ্যে পেরেক থাকে। পেরেকসহ কয়লা মেশিনে মিহি করা সম্ভব নয়। তখন কয়লা রোদে শুকিয়ে তারপর বড় আকারের একটা চুম্বক দিয়ে কয়লা থেকে পেরেক ও লোহাজাতীয় জিনিস আলাদা করা হয়।
বিজলা গাছের ছাল সাধারনত বরিশাল থেকে সংগ্রহ করা হয়। কয়লা সংগ্রহ করা হয় ঢাকার বিভিন্ন হোটেল থেকে। এছাড়া ঢাকার বাইরে থেকেও কয়লা আসে। কাঠের গুঁড়ো ‘স’ মিল থেকে সংগ্রহ করা হয়। কয়লা ও কাঠের গুঁড়ো মিহি করতে বস্তাপ্রতি ১২০-১৫০ টাকা খরচ পরে। কাজলি গাছের বাকল মিহি করতে খরচ হয় ২৩০-২৫০ টাকা। তবে মেশিনে যতই ভাঙানো হোক, কিছু বড় অংশ থেকে যায়। তাই পাউডার চালনি দিয়ে চালতে হয়। গেন্ডারিয়ার দিকে খুঁজে পাওয়া যাবে এই শ্রমিকদের যারা এসব গুঁড়ো মিহি করতে চালনি দিয়ে চেলে থাকে।
৩। সব উপাদান ভালো করে সঠিক মাত্রায় একত্রে মিশিয়ে পানি দিয়ে মাখিয়ে* আটার দলার মতো করা হয়। যাকে লাছা বলা হয়। বিজলা বা আগর গাছের মিশেলের সঙ্গে বাড়তি কিছু দিতে হয় না, এমনিতেই আঠালো হয়ে যায়। তবে ছাইয়ের মিশেলের সঙ্গে বাড়তি আঠা ও পারফিউম ব্যবহার করা হয়।
*আসলে ডিপিই তেল দিয়ে মেখে আগরবাতি তৈরি করা উচিৎ। কিন্তু উৎপাদন খরচ আরো কমানোর জন্যে ডিপিই তেল এর বদলে শুধু পানি ব্যাবহার করা হয়
৪। রঙ মাখা কাঠের গুঁড়ো পিঁড়িতে রেখে, কাঠি তার উপর রেখে ডলে ডলে মশলা কাঠিতে লাগাতে হবে। কাঠিতে মশলা লাগানোর সময় হাতে রঙিন গুঁড়ো লাগিয়ে নিতে হবে। মশলা মাখানোর পর পাশে রাখা ট্রেতে কাঠিগুলো রাখতে হবে। এর পর এই কাঠিগুলো রোদে দিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। ২-৩ ঘণ্টা শুকালেই হয়ে যায় আগরবাতি। সারা দিন কাজ করলে ২০ কেজি আগরবাতি বানানো সম্ভব। দুই মণ পরিমাণ আগরবাতি কাঠির বস্তা ৪৫০০-৫০০০ টাকায় কিনতে পাওয়া যায়। এক বস্তায় আগরবাতির কাঠি থাকে ৪৮ কেজি। কাঠিগুলো একসঙ্গে পরিষ্কার জায়গায় রেখে তরল সেন্ট/ সুগন্ধি আগরবাতিতে ছিটিয়ে মেখে দিতে হবে। আগরবাতিগুলো সাথে সাথে ১২টা করে সেলোফিন কাগজে/পলিথিনে ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করে শক্ত কাগজের প্যাকেটে রেখে দিতে হবে। নির্দিষ্ট পরিমাণে প্যাকেটে ভরে বিক্রির ব্যবস্হা করতে হবে। গুণ, মান ও সুগন্ধির দিকে খেয়াল রাখতে হবে আর আগরবাতি ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে।
অল্প পুঁজি নিয়ে ঘরে বসেই ছোট আকারে আগরবাতি তৈরি শুরু করা যায়। আগরবাতি তৈরি করে বিভিন্ন দেকোনে সরবরাহ করে আয় করা সম্ভব।
আইডিয়া থেকে সাইড আইডিয়াঃ আগর গাছ চাষ
আগরের বৈজ্ঞানিক নাম Aquilaria agallocha আগর বাণিজ্যিকভাবে Agor”, “Aloe Wood”, “Eagle Wood” নামে পরিচিত। আগর গাছের রেসিন হতে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে আগর তৈল উৎপন্ন করা হয়। আগর গাছে কৃত্রিমভাবে তারকাঁটা গেঁথে ছত্রাক উৎপাদনের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা হয় এবং এ জন্যই তারকাঁটা লাগানো হয় বর্ষার শেষে বা শরতের প্রথম দিকে যেন ছত্রাকের বিস্তারের অনুকূল তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা থাকে।
প্রধানতঃ রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইছড়ি, সারোয়াতলী, মারিশ্যা ও খেদারমারা ইউনিয়নে আগর চাষ করা হয়ে থাকে । এর কারন হলো, পাহাড়ের মাটি আগর চাষের উপযোগী ও আবহাওয়া দিক দিয়েও আগর চাষের জন্য উপযুক্ত স্থান ফলে এই এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে আগর গাছে সৃগন্ধি পাওয়া যায়। এ এলাকার প্রায় ১০০০০ একর জমিতে আগর চাষ করা হয়ে থাকে। একেকটি আগর গাছের দাম পাওয়া যায় ২৫-৩০ হাজার টাকা। আগর চাষ করার জন্যে পরিপক্ক বীজ সংগ্রহ করে নার্সারি করা হয়। পরে চারার বয়স নয় মাস হলে বাগানে লাগাতে হয়। বাংলাদেশের মৌলভীবাজার ও সিলেটের কিছু এলাকায় আগর শিল্প ধীরে ধীরে বিস্তারলাভ করছে। আগর হল ট্রপিক্যাল পত্রপতনশীল উদ্ভিদ। এটি যে কোন পরিবেশে জন্মাতে পারে। তবে যে সব অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বেশি, সুনিষ্কাশিত ভূমি, আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা, রেসিন উৎপাদনে সহায়ক ছত্রাকের জন্য উপযোগী সেসব অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে আগর চাষাবাদ করা উচিত।
বাংলাদেশে বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা আগর শিল্প প্রসারের জন্য উপযুক্ত। আগর গাছ বীজ দ্বারা বংশবিস্তার করে এবং বীজ হতে চারা উৎপন্ন করে জুন-জুলাই মাসে। ১০-১২ ফুট দূরত্বে রোপণ করে ৫-৮ বছর পর তারকাটা দ্বারা গাছে রেসিন উৎপাদনের মাধ্যমে ডিসটিলেশন প্রক্রিয়ায় পরবর্তীতে আগর তৈল পাওয়া যায়। সত্যিকার আগর তৈল পানির চেয়ে ভারী। এই তেল সুগন্ধি আগরবাতি, আতর, পারফিউম, লোশন, তেল, ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হয় এবং ভেষজগুণ সম্বলিত বলে ভেষজ ওষুধে ব্যবহৃত হয়। আগর তেলের বাজারমূল্য কল্পনাতীত। ১ কেজি আগর তেল আড়াই থেকে তিন লাখ টাকায় বিক্রয় হয়।
লেখক- সামিউর রহমান