ভূমিকাঃ
মোমবাতি আমাদের সবার কাছে একটি অতি পরিচিত নাম। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগেও মোমবাতির কদর এতটুকু পরিমাণ কমেনি বরং অব্যাহত লোডশেডিংয়ের যাঁতাকলে পিষ্ঠ আধুনিক সুসভ্য শহরবাসীর জীবন যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায় তখন মোমবাতিই পরম বন্ধুর মতো আমাদের আলো দেয়। তাই শুধু গৃহবাসী নয়, দোকানি বা ব্যবসায়ীদের কাছেও এটি খুব দরকারি ও প্রিয় একটি পণ্য। এছাড়াও সব ধর্মের লোকের কাছে মোমবাতি সমানভাবে সমাদৃত। বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে তাই মোমবাতির প্রচলন অত্যাধিক। মোমবাতি জ্বালিয়ে জন্মদিন পালন করা হয়। কিন্তু এত উপকারী এটি পণ্য তৈরির কলাকৌশল আমরা অনেকেই জানি না। জানলে হয়তো আমাদের মতো বিপুল বেকারের এদেশে মোমবাতি শুধু একটি বাতি না হয়ে আত্নকর্মসংস্হানের একটি মাধ্যমে হতে পারে। এ লক্ষ্য সামনে রেখেই এবং কৌতুহলী লোকদের জানার স্বার্থে আমরা মোমবাতি তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণদানের প্রয়াস পেয়েছি। নিচে মোমবাতি তৈরির উপাদান, পদ্ধতি, যন্ত্রপাতি সম্পর্কে তথ্য দেয়া হলো।
মোমবাতি কি ও কত প্রকারঃ
আজকাল নানা আকার ও রঙের মোমবাতি দেখা যায় যেগুলো বেশ আকর্ষণীয়। এটা প্রমাণিত যে, মোমবাতি তৈরি ও বিক্রয় সবদিক থেকেই লাভজনক একটি ব্যবসা। কারণ মোটামুটি কম পুঁজি দিয়েই এই ব্যবসাটি শুরু করা যায়। আবার যারা কম পুঁজি খাটিয়ে বাড়তি আয় করতে চান তারা এই ব্যবসাটি সহজেই করতে পারেন। তাছাড়া এই কাজটি পরিবারের সবাই মিলেও করা যায়। আর সারা বছরই মোমবাতি ব্যবহার করা হয়। বিশেষত পরীক্ষার সময়গুলিতে যেসব এলাকায় বিদ্যুত বেশ সমস্যাজনক একটি ব্যাপার সেসব এলাকায় মোমবাতির বিক্রি বাড়তে বাধ্য।মোমবাতি দুই প্রকারের হয়।যেমন:১. নিত্যদিনের ব্যবহার্য সাধারন মোমবাতি২. ঘর সাজানোর জন্য রঙীন কারুমোম
মোমবাতি কি কি উপাদান দিয়ে তৈরী করতে হবে ও উপাদানগুলো কোথায় পাওয়া যাবেঃ
মোমবাতি বানাতে সাধারণত দুই ধরনের জিনিস লাগে। যেমন:
ক. কাঁচামাল: যেকোন জিনিস তৈরী করার জন্য দরকারি কাঁচামাল যোগাড় করা ও কেনার উপর ব্যবসার লাভ-ক্ষতি অনেকটা নির্ভরশীল। মোমবাতি করতে যেসব কাঁচামাল লাগে তাদের নাম ও প্রাপ্যতার স্হান নিচে দেওয়া হলো:কাঁচামালের নাম এগুলো কোথায় পাওয়া যাবে কাঁচামালের পরিমান কাঁচামালের আনুমানিক দাম (টাকায়)
১. সাদা মোম বা প্যারাফিন স্হানীয় কেমিক্যালসের দোকানে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা ২২০০.০০-৩০০০.০০
২. ইস্টিয়ারিক এসিড স্হানীয় কেমিক্যালসের দোকানে ৫০ কেজি ১৬০০.০০ – ২৫০০.০০
৩. সুতি সুতা যে কোন সুতার দোকানে প্রতি কেজি ৭০.০০-৯০.০০
৪. রং যে কোন রঙের দোকানে প্রতি কেজি ৭০.০০
৫. সয়াবিন তেল
৬. প্যাকেট কাগজ কিনে নিজেরা তৈরি করে নেওয়া যায় ১০ কেজি ১৫০.০০
৭. লেবেল (যদি লাগে) প্রেস থেকে ছাপাতে হবে ১০০০ পিস ৫০০০.০০
৮. আঠা মুদি দোকানে ১ কেজি ৫০.০০ মোট= ৯১৬০.০০ – ১০৮৮০.০০
এখন আসুন সংক্ষেপে জেনে নেই এসব কাঁচামাল আসলে কি জিনিস: সাদা মোম বা প্যারাফিন: এটি এক ধরনের খনিজ মোম যা খনি থেকে পাওয়া যায়। সাদা রঙের এ মোমের কোনো গন্ধ ও স্বাদ নেই ও তা অল্প তাপে সহজেই গলে যায়। সাধারনত ৪৬° থেকে ৬৮° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় প্যারাফিন গলে যায়, তবে যেটি ৫৮° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় দ্রবিভূত হয় তাই মোমবাতি তৈরীর জন্য সবচেয়ে উপযোগী। প্যারাফিন শক্ত, কম শক্ত ও নরম পাওয়া যায়, মোমবাতি তৈরি করার জন্য শক্ত প্যারাফিন ভালো।
পশুর চর্বি থেকে তৈরী ইস্টারিক এসিড পাম অয়েল থেকে তৈরি ইস্টারিক এসিড ইস্টিয়ারিক এসিড: ইস্টারিক এসিড পশু চবি বা তৈল থেকে অথবা পাম অয়েল থেকে তৈরি এক ধরনের এসিড যা দেখতে কঠিন মোমের মত। এটিও অল্প তাপে গলে যায়। প্যারাফিনের সাথে ইস্টারিক এসিড পরিমাণমতো মেশালে তৈরি মোম উন্নতমানের হয়। এর ফলে মোম বাতি শক্ত হয়, মোম তাড়াতাড়ি গলে যায় না ও মোমবাতি বেশি সময় ধরে জ্বলে। তাই প্যারাফিন ও ইস্টারিক এসিড পরিমাণমতো মেশাতে হবে। কারণ তা কম বা বেশি হলে মোমবাতির মান ভালো হবে না। সাধারণত ১০ ভাগ প্যারাফিনের সাথে ১ ভাগ ইস্টিয়ারিক এসিড মেশানো ভালো।
সলতে: মোমবাতি তৈরির জন্য ঢিলাভাবে পাকানো কার্পাস সুতা প্রয়োজন। মোমের সাইজ অনুযায়য়ী এই সুতা চিকন ও মোটা হবে। মোটা ব্যাসের মোমের জন্য মোটা পরতের সুতা এবং চিকন ব্যাসের মোমের জন্য চিকন পরতের সুতা নিতে হবে। সলতের সুতা অবশ্যই সুতি হতে হবে। আর গলা মোমে সুতা চুবিয়ে মোমের প্রলেপ দিতে হয়।
রং: মোমবাতি সুন্দর দেখানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের রং ব্যবহার করা হয়। এজন্য আলাদাভাবে মোমের রং কিনতে পাওয়া যায় যা দেখতে পাউডারের মত গুঁড়ো। আবার বিভিন্ন রং মিশিয়েও নতুন রং পাওয়া যায় যা অনেক সময় নিজেরাই তৈরি করে নেওয়া যায়।
ডাইস বা ছাঁচ: বাজারে বিভিন্ন ধরনের ছাঁচ পাওয়া যায় যাদের দাম অনেক বেশী। তবে ছাঁচ নিজেরাও তৈরি করে নেওয়া যায়। সাধারণত এইভাবে মোমের ছাঁচ তৈরি করা যায়। যেমন: পাতলা টিন বা লোহা দিয়ে লেদ মেশিনে নিজেদের পছন্দমত তা তৈরি করা যায়। আবার প্লাস্টিকের খেলনা ব্যবহার করেও ছাঁচ বানিয়ে নেওয়া যায়। মনে রাখা দরকার, সাধারণ মোম তৈরি করতে পাতলা টিনের ছাঁচ ব্যবহার করা ভালো। অনেক সময় প্লাস্টার অফ প্যারিস দিয়েও পছন্দমত আকৃতির কোনো জিনিসের ছাঁচ তৈরি করা যায়।
খ. সবসময়ের জন্য দরকারি জিনিসপত্র: মোমবাতি তৈরি করতে যেসব দরকারি জিনিসপত্রগুলো লাগে নিচে তাদের নাম ও প্রাপ্যতার স্হান দেওয়া হলো:
দরকারি জিনিসপত্র
স্হায়ী কাঁচামাল এগুলো কোথায় পাওয়া যাবে কাচামালের আনুমানিক দাম (টাকায়)
১. ডাইস * মোমবাতি তরির কারখানায় * ৭,৫০০.০০
২. কড়াই * থালা-বাটির দোকানে ১২০.০০
৩. পাত্র * থালা-বাটির দোকানে ৬০.০০
৪. ছুরি * থালা-বাটির দোকানে ২৫.০০
৫. কাঁচি * থালা-বাটির দোকানে ৫০.০০
৬. চামচ * থালা-বাটির দোকানে ৬০.০০
৭. মগ * থালা-বাটির দোকানে ১০.০০
৮. বালতি * থালা-বাটির দোকানে ৬০.০০
৯. তুলি * রঙের দোকানে ২০.০০ ১০. স্টোভ * থালা-বাটির দোকানে ১০০.০০
মোট = ৮,০০৫.০০
মোমবাতি কিভাবে তৈরি করতে হবেঃ
আমরা এখন সাধারন মোম ও কারুমোম তৈরির নিয়মগুলো নিচে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো: সাধারণ মোম তৈরির নিয়মসমূহপ্রথমে মোমবাতির জন্য তৈরি পাতলা টিনের ডাইস বা ছাঁচের দুটি অংশ থাকে। প্রথমে এই অংশ দুটি খুলতে হবে। অংশ দুটি খোলার পর ১০ টি খাঁজ বা ছ্রিদ দেখা যাবে। এই খাঁজগুলো সয়াবিন তেলে ভেজানো কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে যাতে পরে জমাট বাধা মোম সহজে বেরিয়ে আসতে পারে। প্রতিটি খাঁজের ভেতর দিয়ে উপর থেকে নিচে টানটান করে সুতা পরিয়ে দিতে হবে। সুতা পরানো হয়ে গেলে ছাঁচের অংশটি বন্ধ করে দিতে হবে। ডাইস বা ছাঁচের দুই পাশে পানি রাখার জন্য দুটি পাত্র থাকে। এই পাত্র দুটি পানি দিয়ে ভরে দিন যাতে চুলা থেকে নামানো গরম মোমগুলো টিনের ডাইসে ঢালার পর টিন গরম না হয়ে যায়। এবার অল্প তাপে কেরোসিন তেল দিয়ে স্টোভ ধরিয়ে তার উপর কড়াই দিয়ে তাতে পরিমাণমতো প্যারাফিন ও ইস্টারিক এসিড (১০ ভাগ মোমের সাথে ১ভাগ ইস্টারিক এসিড) দিতে হবে। ধীরে ধীরে উপাদনদুটো ভালভাবে গলে গেলে তা কড়াই থেকে নামিয়ে তাতে পছন্দ ও পরিমাণমত গুঁড়ো রং মিশিয়ে ভাল করে নাড়াতে হবে। কিছুক্ষণ নাড়ানোর পর পাতলা মিশ্রণটি চামচ দিয়ে ডাইসের উপরের গর্তগুলোতে ঢালতে হবে। ঢালার পর মোমগুলো যখন ধীরে ধীরে শক্ত হতে থাকবে তখন ছাঁচের উপরের গর্তগুলোর মুখ একটু ফাঁকা হয়ে যাবে। এই ফাঁকাটি পূরণ করার জন্য তাতে আবার গলা মোম ঢেলে দিতে হবে। এই কাজটি চলবে ২০ থেকে ২৫ মিনিট। তারপর মোমগুলো শক্ত হয়ে গেলে ছাঁচের অংশ দুটো খুলে আস্তে আস্তে মোমবাতি গুলো বের করতে হবে। তারপর শক্ত ও মসৃণ করার জন্য যেকোনো সমান জায়গায় (টেবিল বা মেঝে) একটি সাদা কাগজ বিছিয়ে তার উপর মোমবাতিগুলো রেখে তাদের চারপাশ ও নিচের দিক ছুরি দিয়ে সমান করতে হবে। সেইসাথে বাড়তি সুতা থাকলে তাও কেটে দিতে হবে। সবশেষে কিছুক্ষণ মোমবাতিগুলো শক্ত করার জন্য হাত দিয়ে গড়াগড়ি করতে হবে। এভাবেই সাধারণ মোমবাতি তৈরি হয়ে যাবে।
কারুমোম তৈরির নিয়মসমূহমোমহলো বিভিন্ন জিনিসের নকশার মাধ্যমে তৈরি মোম যা বর্তমানে প্রায় সবাইকেই আকর্ষণ করে। তাই গ্রামের বাজারগুলোতেও আজ নানা নকশার এই মোম ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন: ফুল, পাখী, জীব-জন্তু, পুতুল, মূর্তি ইত্যাদি।
কারুমোম দুই ধরনের হয়:এক ধরনের কারুমোম যা সলতে দিয়ে জ্বালানো যায় ঘর সাজানোর কারুমোম ।
কারুমোম তৈরির নিয়ম সাধারন মোমের মতই তবে ঘর সাজানো যায় এমন কারুমোম ইস্টারিক এসিড না মেশালেও চলে। কারণ এই মোম জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করা হয় না। চলুন জেনে নেই কিভাবে এই মোম সহজে তৈরি করা যাবে: প্রথমে মোমের আকৃতি ঠিক করতে হবে। তারপর সেসব আকৃতির ছাঁচ সংগ্রহ করতে হবে। বাজারে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকের খেলনা পাওয়া যায় যাদের ভিতরের অংশ ফাঁকা থকে। এই ফাঁকা জায়গাকেই ছাঁচ হিসেবে কাজে লাগানো যায়। মনে করি আমরা পাখির আকৃতির মোম বানাবো। এজন্য প্লাস্টিকের একটি খেলনা পাখি সংগ্রহ করে পাখিটিকে মাঝখান থেকে সমান দুইভাগে কেটে নিতে হবে। তারপর ভিতরের ফাঁকা জয়গায় পরিষ্কার করে সয়াবিন তেলের প্রলেপ দিব।প্রথমে একটি ড্রামের ওজন সইতে পারে এমন সাইজের একটি চুলায় ড্রাম বসাতে হবে।ড্রামে পরিমানুসারে হার্ড পেরাফিন বা মোমের চাক ঢাললে দেখা যাবে চুলার আগুনের তাপে পেরাফিন বা মোমের চাকা গলে পানি রূপ ধারণ করবে।এ অবস্হায় স্দ্বিয়ারিক এসিড দিতে হবে এবং দেখা যাবে তা আগের মতো গলে যাবে। রঙিন মোমবাতি তৈরি করতে চাইলে সেই সঙ্গে প্রয়োজনমতো রং ঢেলে তা ভালোভাবে নেড়ে মেশাতে হবে।এভাবে ড্রামে গলিত মোম মগ দিয়ে ছাঁচে ঢাললে ছাঁচের মধ্যে মোম জমে মোমবাতি হয়ে যাবে।ছাঁচের মোম জমাট বাধার পর দুই অংশকে একএ করে জোড়া দিব। যদি এই মোম জ্বালাতে চান তবে জোড়া দেওয়ার আগে দুই অংশের মাঝখানে সলতে পরিয়ে দিব। অনেক সময় জোড়া নাও লাগতে পারে সেজন্য বাইরে দিয়ে জোড়া অংশে মোমের প্রলেপ দিব।কিছুক্ষণ পর (১০-২০ মিনিট) দুই দিক থেকে প্লাস্টিকের ছাঁচ খুলে ফেলবো। এভাবেই মোমটি তৈরি হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, পাখিটির অন্য কোনো জায়গায় ভিন্ন রং করতে হলে রং মেশানো গলা মোম নিয়ে তুলি দিয়ে রং করতে হবে।
মোমবাতি তৈরি ও ব্যবসা করার সুবিধা ও অসুবিধাগুলো কি কিঃ
অন্য যেকোনো ব্যবসার মত মোমবাতি তৈরি ও তা বিক্রির ব্যবসা করার সময় কিছু সম্যস্য দেখা দিতে পারে। তাই ব্যবসা করতে গেলে এক্ষেত্রে বিদ্যমান সুবিধা, অসুবিধা, সম্ভাবনা, ঝুঁকি ইত্যাদি জেনে ও বুঝে ব্যবসা করা দরকার। মোমবাতির ব্যবসায়ের নানা সুবিধা ও অসুবিধাগুলো নিচে দেওয়া হল-
সুবিধা সমূহ: মোমবাতি তৈরি ব্যবসায় অল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে বেশি আয় করা যায়কাজটি সহজেই শেখা যায়কাজটি পরিবারের সদস্যরা মিলেই করা যায়মোমবাতির চাহিদা প্রায় সারা বছরই থাকেকাজটি করে একটি ছোট পরিবার সহজেই চলতে পারেনতুন প্রযুক্তিতে মোমের আলোতে মশা তাড়ানোর ব্যবস্থাও করা যায়
অসুবিধা সমূহ: মোম ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যের অনুপাত সঠিকভাবে মেশাতে হয়। তা না হলে মোমবাতি ভাল হয় না। যেমন- সাদা মোম ও ইস্টারিক এসিডের অনুপাত ঠিকমত না হলে মোমবাতি শক্ত হয় না।চিকন মোমবাতিতে মোটা সুতার সলতে থাকলে অনেক সময় মোমের সলতেতে আগুন ধরে না ফলে মোমবাতি ভালোমত জ্বলে না। সেইসাথে আলোও কম হয়।সলতের সুতায় যাতে পানি না লাগে সেজন্য আগেই সুতায় মোমের প্রলেপ দিতে হয়।বেশি তাপ দিয়ে মোম গলানো যাবে না। কারণ এতে মোম বাতাসের সাথে মিশে যায় ও মোমে আগুন ধরে যায়। -সাদা মোম ও ইস্টারিক এসিড খুব কম তাপে গলাতে হবে।মোমে আগুন ধরে গেলে প্রথমেই চুলার আগুন নিভিয়ে দিতে হবে। এরপর ঢাকনা দিয়ে মোমের পাত্র ঢেকে দিতে হবে। আগুন নিভানোর জন্য পানি ব্যবহার করা যাবে না কারণ এতে গরম মোমের ছিটে শরীরে লাগতে পারে।চুলার উপর উত্তপ্ত মোমে রং মেশানো যাবে না। চুলা থেকে নামিয়ে তরল মোমে গুড়ো রং মেশাতে হবে।চুলায় মোম গলতে দিয়ে অন্য কাজ করা ঠিক নয় কারণ এত দুর্ঘটনার আশংকা থাকে।সবসময় হাতের কাছে পানি রাখতে হবে কারণ গলা মোম নিয়ে কাজ করার সময় বারবার পানির দরকার হয়। গলা মোম যেন কাপড়ে না লাগে। মোম তৈরিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্য ও কেমিক্যাল শিশুদের নাগালের বাইরে নিরাপদ জায়গায় ও বন্ধ করে রাখতে হবে।কাজ শেষে ডাইস বা ছাঁচ পরিষ্কার করে কড়া রোদে শুকিয়ে রাখতে হবে। এত ছাঁচ বেশিদিন টিকবে।ছাঁচ ব্যবহারের সময় সাবধানে হাত দিয়ে কাজ করতে হবে নাহলে ধারালো অংশের আঘাতে হাত কেটে যেতে পারে। জিনিসপত্রগুলো সবসময়ের জন্য কাজে লাগবে। তাই দেখেশুনে টেকসই জিনিসপত্র কিনতে হবে।
তৈরি মোমবাতি কিভাবে বাজারে বিক্রি করতে হবেঃ
তৈরি যেকোনো ধরনের মোমবাতি নিজেরাই বিক্রয় ও বাজারজাত করা যায়। নিজেরা বিভিন্ন দোকানে তা সরবরাহ করলে মুনাফাও বেশি পাওয়া যায়। আবার ঘরে বসেও মোমবাতি বিক্রয় করা যায় তবে এতে লাভ একটু কম হতে পারে। কারণ যারা ঘরে এসে মোমবাতি কিনে নিয়ে যায় তারা আবার দোকানিদের কাছে বেচে। সরাসরি দোকানে গিয়ে বেচলে পাইকারি ক্রেতাদের লাভের অংশটুকু নিজেদের কাছেই থাকে। মোমবাতি প্যাকেট করে বাজারজাত করতে পারলে ভালো কারণ এতে তা ভালো থাকে। আবার মোমবাতির গুনাগুণ নষ্ট হয় না। আর প্যাকেটের সাথে যদি লেবেল ব্যবহার করা যায় তবে আরও ভালো হয়। কারণ বাজারে যেখানে নানা ধরনের মোম আছে সেখানে এত মোমের মাঝে নিজের মোমের প্রচার হবে। তবে বাজারজাত করার সময় মনে রাখা উচিত যে মোমবাতি খুবই ভারী বস্তু তাই দোকানে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাইসাইকেল ব্যবহার করা ভাল।
মোমবাতি তৈরি ও বিক্রির ব্যবসায় কি ধরনের আয় বা খরচ হতে পারেঃ
যেকোনো পণ্য উৎপাদনের জন্য নানা ধরনের খরচ লাগে। যেমন-কাঁচামালের খরচ, জিনিসপত্র কেনার খরচ, যাতায়াত খরচ ও মজুরিসহ অন্যান্য খরচ। আসুন জানা যাক ২৫০ টি মোম তৈরির ব্যবসায় কি ধরনের লাভ ও ক্ষতি হতে পারে:
কাঁচামালের খরচ
কাঁচামাল পরিমাণ দাম (টাকায়)
সাদমোম ১০০০০ গ্রাম ৫০০.০০
ইস্টারিক এসিড ১০০০ গ্রাম ৫৫.০০
সুতা ২৫০ গ্রাম ১৮.০০
রং ৫০০ গ্রাম ৭.০০
সয়াবিন ৫০ গ্রাম ২.০০
প্যাকেট ২৫ টি ২৫.০০
লেবেল ২৫ টি ২.৫০
আঠা আনুমানিক ৫.০০
মোট = ৬১৪.৫০
সবসময়ের জন্য দরকারি জিনিসপত্রের খরচ
জিনিসপত্র পরিমাণ দাম (টাকায়)
ডাইস ১ টা ৭৫০০.০০
কড়াই ২ টা ১২০.০০
পাত্র ২ টা ৬০.০০
ছুরি ১ টা ২৫.০০
কাচি ১ টা ৫০.০০
চামচ ৩ টা ১টা বড়, ২টা ছোট) ৬০.০০
মগ ১ টা ১০.০০
বালতি ১ টা ৬০.০০
কৌটা ৪ টা (ছোট) ২০.০০
স্টোভ ১ টা ১০০.০০
মোট = ৮,০০৫.০০
অন্যান্য খরচ
খরচের খাত টাকার পরিমাণ
কাঁচামাল ও জিনিসপত্র কেনা ও মোমবাতি বেচার জন্য) ১০০
জ্বালানি (কেরোসিন)-১ কেজি ২০
মজুরি-১ দিন ৬০
মোট =১৮০
৩টি খাতের মোট খরচ
খরচের খাত টাকার পরিমাণ
কাঁচামাল ৬১৪.৫০
স্হায়ী খরচ (মোট খরচের ০.০৫%) ৪.০০
অন্যান্য খরচ ১৮০.০০
মোট =৭৯৮.৫০
উপরের হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে-৭৯৮.৫০ টাকা খরচ করে ৫.০০ টাকা দামের ২৫০টি মোম উৎপাদন করা যাবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি মোম ৪.০০ টাকা দরে দোকানে বেচা যাবে। এই দরে বেচলে ২৫০টি মোমের মোট দাম পাওয়া যাবে-১০০০ টাকা। এই হিসাব থেকে সহজেই প্রকৃত লাভ বের করা যায়। যেমন-
২৫০ টি মোম দোকানে বেচে পাওয়া যাবে ১০০০.০০ টাকা
২৫০ টি মোম তৈরি করতে খরচ হয়েছে ৭৯৮.৫০ টাকা
প্রকৃত লাভ =২০১.৫০ টাকা
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ১দিনে ২৫০টি মোমবাতি তৈরি করে বেচার পর ২০১.৫০ টাকা লাভ করা যেতে পারে। এখানে একটি নির্দিষ্ট সময়ের বাজার দরের ভিত্তিতে আয়-ব্যযের হিসাব বের করা হলো। কিন্তু কাঁচামাল ও জিনিসপত্রের দাম প্রায়ই ওঠানামা করে তাই এই হিসাবটি কম বা বেশি হতে পারে।
সুতরাং বলা যায় যে, অন্যান্য অকৃষি উদ্যোগের মতই মোমবাতি তৈরি এখনও বেঁচে থাকার একটি ভালো উপায় হিসেবে অনেক দরিদ্র মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য। তাই আজকের বেকার যুবক-যুবতীদের জন্য এমনকি পড়াশোনার পাশাপাশি বাড়তি আয়ের সংস্হান করার একটি উতকৃষ্ট উপায় হতে পারে মোমবাতি তৈরি করে বিক্রি করা।
প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোঃ
১. বিসিক নকশা কেন্দ্র : ১৩৭/১৩৮ মতিঝিল বা/এ, ঢাকা। ফোন : ৯৫৫৬১৯১, ৯৫৫১১২০ফ্যাক্স : ৮৮-২-৯৫৫০৭০৪
২. গোল্ডেন ভিলেজ : ৮২/১২ বি-উত্তর যাত্রাবাড়ী, ফোন : ৭৫১২৪৮৬।
৩. সুমাত্রা যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র : ২৯/১৬ বি, তাজমহল রোড, ব্লক – সি, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।